ভাষাসুখ , ভাষাদুঃখ – পবিত্র সরকার
Author : Pabitra Sarkar
Publisher : Ebong Adhyay - এবং অধ্যায়
ভাষা মরে নানাভাবে। এক, যুদ্ধে, মড়কে বা দুর্ভিক্ষে, কিংবা আরও নানা কারণে ভাষাগোষ্ঠীর সকলের মৃত্যু হতে পারে, অস্ট্রেলিয়ার তাসমানিয়ার আদিবাসীদের যেমন ইংরেজরা মেরে শেষ করে দিয়েছিল ১৮৩০ নাগাদ। এ রকম রাতারাতি খুন বা Sudden Death তো আছেই। তার পরে আছে ধীরে ধীরে কিন্তু সম্পূর্ণ মৃত্যু, Radical Death, যেখানে শক্তিশালী ভাষাগোষ্ঠের অত্যাচারে দুর্বল ভাষার লোকেরা নিজেরাই নিজেদের ভাষা বলা বন্ধ করে দেয়। মার্কিনদেশের অনেক আদি আমেরিকান (আগেকার ‘রেড় ইন্ডিয়ান’ কথাটা ওরা আর ব্যবহার করে না, বলে ‘নেটিভ অ্যামেরিকান’) ভাষার এইভাবে মৃত্যু ঘটেছে। স্কুলে ওদের ছেলেরা ইংরেজি না বলে নিজেদের ভাষা বললে তাদের গলায় কাটা শুয়োরের মাথা ঝুলিয়ে শাস্তি দেওযা হত এক সময়ে। তার পর আছে ক্রমবদ্ধ মৃত্যু বা Gradual Death, বেশিরভাগ ভাষার ক্ষেত্রে যা ঘটেছে। আর-এক ধরনের মৃত্যু আছে তলার দিক থেকে মৃত্যু—Bottom to Top Death, যেখানে লোকে ভাষাটা বলতে ভুলে যায়, কিন্তু নানা ধর্মীয় ব্যাপারে ভাষাটার ব্যবহার থাকে, যেমন সংস্কৃত আছে ভারতে, লাতিন আছে খ্রিস্টধর্মের কোনও কোনও অংশে।
Publisher | Ebong Adhyay - এবং অধ্যায় |
Binding | Hardboard |
Language | Bengali |
ভাষা মরে নানাভাবে। এক, যুদ্ধে, মড়কে বা দুর্ভিক্ষে, কিংবা আরও নানা কারণে ভাষাগোষ্ঠীর সকলের মৃত্যু হতে পারে, অস্ট্রেলিয়ার তাসমানিয়ার আদিবাসীদের যেমন ইংরেজরা মেরে শেষ করে দিয়েছিল ১৮৩০ নাগাদ। এ রকম রাতারাতি খুন বা Sudden Death তো আছেই। তার পরে আছে ধীরে ধীরে কিন্তু সম্পূর্ণ মৃত্যু, Radical Death, যেখানে শক্তিশালী ভাষাগোষ্ঠের অত্যাচারে দুর্বল ভাষার লোকেরা নিজেরাই নিজেদের ভাষা বলা বন্ধ করে দেয়। মার্কিনদেশের অনেক আদি আমেরিকান (আগেকার ‘রেড় ইন্ডিয়ান’ কথাটা ওরা আর ব্যবহার করে না, বলে ‘নেটিভ অ্যামেরিকান’) ভাষার এইভাবে মৃত্যু ঘটেছে। স্কুলে ওদের ছেলেরা ইংরেজি না বলে নিজেদের ভাষা বললে তাদের গলায় কাটা শুয়োরের মাথা ঝুলিয়ে শাস্তি দেওযা হত এক সময়ে। তার পর আছে ক্রমবদ্ধ মৃত্যু বা Gradual Death, বেশিরভাগ ভাষার ক্ষেত্রে যা ঘটেছে। আর-এক ধরনের মৃত্যু আছে তলার দিক থেকে মৃত্যু—Bottom to Top Death, যেখানে লোকে ভাষাটা বলতে ভুলে যায়, কিন্তু নানা ধর্মীয় ব্যাপারে ভাষাটার ব্যবহার থাকে, যেমন সংস্কৃত আছে ভারতে, লাতিন আছে খ্রিস্টধর্মের কোনও কোনও অংশে।
প্রথম দুধরনের মৃত্যু আমরা লক্ষ করি। দুটোই ঘটে দুটো ভাষা পাশাপাশি আসার কারণে, দুয়ের সঙ্গে সংঘাতের কারণে। ভাষা তো কাছে এলে মারপিট করে না, মারপিট করে ভাষার মানুষেরা। এক ভাষার মানুষেরা বলে, এই, আমরা তোদের রাজা, তাই আমাদের ভাষাটা না শিখলে সরকারি চাকরি হবে না, ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারবি না। আমাদের ইংরেজ রাজারা ১৮৩৫ সালে চাকরি আর শিক্ষার জন্য ইংরেজি শেখা বাধ্যতামূলক করেছিল, তা তো আপনারা জানেন। এতে আমাদের বেশ কিছু ভালোও হয়েছে তা সবাই জানে, আমরাও অস্বীকার করব না। বাংলায় ‘নবজাগরণ’ হয়েছে, ঊনবিংশ শতাব্দীতে মহাপুরুষেরা এসে বাঙালিকে পৃথিবীর নাগরিক করে দিয়েছেন।
কিন্তু কিছু রীতিমতো খারাপও যে হয়েছে, তা হয়তো সবাই জানেন না, বা ইংরেজ বা ইংরেজির প্রতি ভক্তিবশত মানেন না। খারাপ কী হয়েছে, কেন হয়েছে ? প্রথমত ইংরেজি লেখাপড়ার মাধ্যম হওয়ার জন্য আমাদের দেশের মানুষ প্রথম দিকে লেখাপড়া শিখেছে খুব কম। ওয়েবসাইটেই পাবেন ঊনবিংশ শতকের দশক দশক ধরে ভারতীয়দের সাক্ষরতা, অর্থাৎ লেখাপড়া শেখার হিসেব। একশো জনের মধ্যে কতজন কীভাবে লেখাপড়া শিখেছে তার পরিসংখ্যান দেখলে আপনারা তাজ্জব হয়ে যাবেন। যখন ইংরেজি মাধ্যম ছিল (১৮৭২-১৯৩১) তার হিসেব হল—১৮৭২—৩.৭৫, ১৮৮১—৪.৩২, ১৮৯১—৪.৬২, ১৯০১—৫.৪, ১৯১১—৫.৯, ১৯২১—৭.২, ১৯৩১—৯.৫। যাঁরা অঙ্কে উৎসাহী তাঁরা হিসেব করুন প্রতি দশকে সাক্ষরতা কী হারে বেড়েছে—খুব কম ক্ষেত্রে দশ বছরে দুইয়ের উপরে উঠেছে।
১৯৪০ থেকে স্কুলশিক্ষায় মাতৃভাষায় পড়ানো অনুমোদিত হল। বম্বে বিশ্ববিদ্যালযে আগেই, ১৯২৯ থেকে হয়েছিল, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে হল ১৯৪০ থেকে। এবার সাক্ষরতা কী হারে বাড়ছে দেখুন—১৯৪১—১৬.১, ১৯৫১—১৮.৩৩, ১৯৬১—২৮.৩, ১৯৭১—৩৪.৪৫, ১৯৬১—৪৩.৫৭—এই ভাবে চলেছে। এই গতি আমরা সব সময় বজায় রাখতে পারিনি, তবু এই করতে করতে আম আমাদের সাক্ষরতা ৭৭.৭-এ এসে পৌঁছেছে, মাতৃভাষায় শিক্ষার ব্যবস্থা না হলে তা সম্ভব হত না।
ইংরেজি শেখার ফলে আমাদের অনেক লাভ হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু আর-একটা ক্ষতিও হয়েছে। সে ক্ষতিটা সামাজিক। তা হল, যারা ইংরেজি শিখল, তারা একটা নতুন ‘ভদ্রলোক’ শ্রেণিতে অবস্থান নিল, আর যারা তা শিখল না, বা ইংরেজের স্কুলে যেতে পারল না, তারা ‘ভদ্রলোক’ হতে পারল না। ‘ছোটলোক’ কথাটা এখন আমরা হয়তো গালাগাল ছাড়া তত ব্যবহার করি না, কিন্তু এক সময় ‘না-ভদ্রলোক’দের ওই নামেই চিহ্নিত করতাম আমরা—নিরক্ষর চাষি, জেলে, শ্রমিকদের আমরা তাই বলতাম। আর যারা স্কুলে ঢুকতে পারেনি, তাদেরই আমরা ‘অশিক্ষিত’ বলতে অভ্যস্ত হলাম, যদিও স্কুলে পড়া আর শিক্ষা এক জিনিস নয়। পুরুষানুক্রমে, হাতে-কলমে, মুখে মুখে শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষেরাই দীর্ঘদিন আমাদের সমাজকে লালন করে এসেছেন। চাষিরা, ব্যবসায়ীরা, মৎস্যজীবীরা প্রত্যেকে নিজেদের পেশায় যেমন ‘শিক্ষিত’ হয়েছেন, তেমনই রামায়ণ-মহাভারত, বয়েতগান কথকতা শুনে মানবিক শিক্ষা আর নীতিবোধও আয়ত্ত করেছেন। কিন্তু ইংরেজি স্কুলে পড়েননি বলে আমরা তাঁদের ভদ্রলোকের সমাজ থেকে নির্বাসনে পাঠালাম।
Book Review
There are no reviews yet.